সেই শৈশবকাল থেকে ভক্তদাকে চিনতাম। রামভদ্রপুর, আমার মামারবাড়ি- যেখানে আমার কৈশোর কেটেছে, সেখানকার সুধুবাবুর বাড়ির নাট্যমঞ্চে ‘শাপলা সংঘ’ নামক একটি সংগঠন প্রতিবছর তিন-চারটি ক্লাসিক যাত্রাপালার আয়োজন করত। এসব পালায় নেত্রকোনা থেকে বাদ্যযন্ত্রী হিসেবে যেতেন ভক্তদা। একই পালায় কখনও তবলা বা বঙ্গ বাজাতেন, আবার কখনও ড্রামসেট বাজাতেন তিনি। কলাকুশলীরা যখন মঞ্চে নৃত্যগীত বা উচ্চস্বরের সংলাপ বলতেন অথবা নায়ক-খলনায়কেরা যখন যুদ্ধের দামামায় মেতে ওঠতেন, তখন ভক্তদা তাঁর তালবাদ্যে অদ্ভুত এক মূর্ছনার সৃষ্টি করতেন, যা একেকটি দৃশ্যকে জীবন্ত করে তুলতো। মামাদের সঙ্গে দু-চারবার আমি নিজেও নায়ক-খলনায়কদের শিশুচরিত্রে অভিনয় করেছি। মা চরিত্রের অভিনেত্রীরা মঞ্চে আমাকে জড়িয়ে ধরে গান করেছেন, ‘ঘুম নেমেছে খোকার চোখে—।’ সে সময় ভক্তদার তালবাদ্য যেন সত্যিই আমাকে ঘুমপুরীতে নিয়ে যেতো। সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
নেত্রকোনায় সাংবাদিকতা, লেখালেখি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার পর ভক্তদা-র সঙ্গে ঘনিষ্টতা বাড়ে। এখানকার যাত্রাশিল্প নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ, ফিচার ও নিউজ লিখেছি আমি। এসব লেখার রসদ জুগিয়েছেন যাত্রাশিল্পী দীন ইসলাম ভাই ও ভক্তদা। মনে পড়ে, ভক্তদা আর দীন ইসলাম ভাইকে নিয়ে রেলক্রসিং এলাকার সাজঘরে বসে কত আলোচনা করেছি। এখানকার যাত্রাজগত সম্পর্কে কত কী জেনেছি। করোনাকালে একদিন ভক্তদা ও দীন ইসলাম ভাই যাত্রাশিল্পী এবং বাদ্যযন্ত্রীদের (ব্যান্ডপার্টি) দুর্দিন নিয়ে লিখতে বললেন। তারা কিছু শিল্পীর করুণদশার তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করলেন। জনকণ্ঠের শেষ পৃষ্ঠায় ফিচার লিখেছিলাম। জেলা প্রশাসক ও শিল্পকলা একাডেমিকে অনুরোধ করে কিছু সহযোগিতাও আদায় করে দিয়েছিলাম। কিছুদিন আগেও ভক্তদার সঙ্গে দেখা রেলক্রসিংয়ে। কিছু আক্ষেপের কথা জানিয়েছিলেন দীন ইসলাম ভাই।
যাত্রাশিল্পীরা একেকজন একেক ধরনের পারফর্ম করে থাকেন। কেউ নায়কের অভিনয় করেন। কেউ নায়িকার। কেউ পার্শ্বচরিত্রের। আবার কেউ খলনায়কের। যাত্রার বাদ্যযন্ত্রীরাও ঠিক একেকজন একেক ধরনের বাদ্য বাজিয়ে থাকেন। কিন্তু ভক্তদা-কে সুনির্দিষ্ট করে কী বাদক বলা যায়? তবলা বাদক? ড্রামসেট বাদক? বঙ্গ বাদক? কিন্তু আমি তো দেখেছি, তিনি এমন কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই যা বাজাতে পারতেন না। আবার শুধু বাজাতেন বড় কথা না। এমন বাজাতে ক’জন পারেন- সেটি নিয়েও আমার প্রবল সন্দেহ আছে। আমার মনে হয়, নেত্রকোনার যাত্রাজগতে এমন একটা সময় গেছে, ভক্তদা না গেলে সেদিনকার পালায় রীতিমতো অঙ্গহানি ঘটে যেত। এমন পারদর্শী শিল্পী আমি জীবনে দ্বিতীয়জন দেখিনি। শেষ জীবনে বিবেক গায়কের যখন সঙ্কট দেখা দিল, তখন তিনি নিজেই বিবেক সেজে গেলেন। ভালোই গাইতেন। এমনই এক ডায়নামিক শিল্পী ছিলেন ভক্ত চন্দ্র দাশ।
একবার কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। আমার স্ত্রীর বড় ভাইয়ের বিয়ে। শ্বশুরমশাই বললেন, ভালো একটা ব্যান্ডপার্টি ঠিক করতে। আমি রেলক্রসিংয়ে দীন ইসলাম ভাই আর ভক্তদাকে নিয়ে বসলাম। ভক্তদা দায়িত্ব নিলেন। আমি বয়ানা করে তারিখ ও ঠিকানা দিয়ে চলে আসলাম। বিয়ের আগেরদিন শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দেখি ভক্তদা নিজেও ওই দলের সঙ্গে হাজির। বিষ্ময় বোধ করলাম! বিয়ের ব্যান্ডপার্টিতে তো যাত্রাগানের মতো তবলা, বঙ্গ বা ড্রামসেট থাকে না। তাহলে ভক্তদা কী বাজাবেন? একটু পর দেখলাম ভক্তদা ড্রাম (ঢোল) বাজাচ্ছেন। অনেক কথা হল ওইদিন। দাদা বললেন, ‘আমি কমবেশি সবই বাজাতে পারি।’ আমিও তাই দেখলাম। তিনি যেটাতে হাত দেন, সেটাই বাজে। অদ্ভুত এক প্রতিভা তাঁর। তাঁর হাতের স্পর্শে একেকটা বাদ্যযন্ত্র রীতিমতো কথা বলতো। দর্শকরা একদিকে যেমন মঞ্চের অভিনয় দেখতেন, আরেকদিকে দেখতেন ভক্তদার হাতের কারিশমা। আমার বিশ্বাস, আজকের দিনে ভক্তদার মতো প্রতিভাবান শিল্পী বিরল। অথচ জীবদ্দশায় কোনো মূল্যায়নই পাননি। এত প্রতিভা থাকার পরও একটু স্বচ্ছলতার মুখ দেখেননি জীবনে।
দু-তিন আগে ফেসবুকে হঠাৎ ভক্তদার অসুস্থতার সংবাদ জানার পর ভেবেছিলাম একবার দেখতে যাব। কিন্তু যাওয়া আর হলো না। আজ বিকেল ৫ টায় অনন্তলোকে চলে গেলেন। এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন বুঝতেই পারিনি। আর আমি গেলেই কী হতো? এ জীবনে কত লোকশিল্পীর সঙ্গেই তো মিশেছি। যখন তাঁদের কাছে যাই, সুন্দর সুন্দর কথা বলি। দু-চার কলম লিখি। বাহবা কুড়াই। আর তাঁরা আশায় বুক বাঁধেন। ভাবেন, এইবার হয়তো কিছু হবে। কিন্তু আদৌ কি কিছু হয়? কত শিল্পী-কলাকুশলী আজ নিদানে আছেন, তার কী কোনো হিসাব আছে? কেউ কি সে হিসাব রাখে? চোখের সামনেই তো কবিয়াল মদন ঠাকুরকে দেখেছি। তার মেয়ে বিভা রানী আজ কী করেন সবাই জানি। বাউল ইসলাম উদ্দিনের কথাও বোধ হয় মনে আছে অনেকের। সমাজের প্রতিটা পরতে পরতেই তো ছড়িয়ে আছেন এমন মদন ঠাকুর, বিভারানী, ইসলাম উদ্দিন বা ভক্ত চন্দ্র দাশেরা। যাদের ভাববার কথা তারা কী ভাবে তাদের নিয়ে? আমি জানি না। এখন আর জানার ইচ্ছেও জাগে না। এই লেখাটি যখন লিখছি, ঠিক তখই ফোন করলেন এক প্রবীণ বাউল। জানতে চাইলেন কেমন আছি? আমি তাঁর চিরচেনা কণ্ঠের ভাষা বা আর্তি বুঝি। কিন্তু বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকি। কী করার আছে আমার, আমাদের মতো দুর্ভাগাদের!
প্রিয় ভক্ত দা। কেউ স্বীকৃতি দিক আর না দিক, আপনি আমার দেখা একজন শ্রেষ্ঠ লোকশিল্পী। আপনিই ছিলেন আমাদের ওস্তাদ আল্লারাখা বা জাকির হোসেন। যতদিন বাঁচবো, ততোদিন আমার শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত রামভদ্রপুরের সরকারবাড়ির সেই যাত্রামঞ্চটির কথা মনে থাকবে, আপনার বিদ্যুৎগতির হাতে বাজানো ড্রামসেটের তাল-বাদ্য মনে থাকবে, আপনার সুনিপুণ তবলার লহরী মনে থাকবে, আপনার গাওয়া বিবেকের গান মনে থাকবে, আপনার যৌবনকালের বাবরি চুল ও শান্ত-সৌম্য চেহারাটি মনে থাকবে, আপনার চাওয়াপাওয়া বিহীন অতি সাধাসিধে জীবনের সাবলীল আচরণগুলো মনে থাকবে। অনন্তলোকে ভালো থাকুন দাদা। আপনাকে প্রণাম। সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা। ৭ মে ২০২৫
আপনার মতামত লিখুন :