Banglarnetro
Dr. Neem Hakim

শৈশব থেকে কৈশোর: এক কিশোরীর না বলা গল্প– ফাইজা রহমান অনু


বাংলার নেত্র প্রকাশের সময় : এপ্রিল ৮, ২০২৫, ৪:৩৬ অপরাহ্ণ / ৭৬
শৈশব থেকে কৈশোর: এক কিশোরীর না বলা গল্প– ফাইজা রহমান অনু

সবচেয়ে আনন্দময় দিনগুলোর মধ্যে আজও মনে পড়ে ছোটবেলাটা।
চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে কিছু না ভোলা স্মৃতি—শৈশব থেকে কিশোরীতে পা রাখার দিনগুলো।
সময় যেন পানির স্রোতের মতো বয়ে গেল, চাইলে আর ফেরানো যাবে না।

১০ থেকে ১১ বছর বয়সে যেটাকে বলা হয় কৈশোর—এই সময়েই ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শুরু হয় শারীরিক পরিবর্তন।
শৈশবের নিরাপদ, স্নেহভরা পরিসর থেকে বেরিয়ে একটা কিশোরী যখন নিজের শরীরের পরিবর্তন টের পায়, তখন সেটা তার কাছে একেবারেই নতুন।
সে বুঝতে পারে না, মানিয়ে নিতে পারে না। লজ্জায়, ভয়েতে—কারও সঙ্গে সেভাবে শেয়ারও করতে পারে না।

না মা-বাবার সাথে, না বড় ভাই-বোনের সাথে তার সম্পর্কটা এতটা বন্ধুত্বপূর্ণ থাকে যে সে নিজের কথা বলতে পারে।
ফলে সে একা হয়ে পড়ে—মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।

এই সময়টা, যা তার বেড়ে ওঠার আনন্দময় সময় হওয়া উচিত ছিল, তা হয়ে ওঠে দুঃখময়।
কারণ, একজন মেয়ের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাভাবিক একটি পরিবর্তন—মাসিক (পিরিয়ড)—শুরু হয়।
আমরা এটাকে এমনভাবে উপস্থাপন করি যেন এটা কোনো লজ্জার বিষয়!
লজ্জায়, ভয়েতে মেয়েটি নিজের মাকেও জানাতে পারে না—সে যে আজ একজন নারী হয়ে উঠছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এটা কোনো লজ্জার বিষয় নয়।
এই পিরিয়ডের কারণেই একজন নারী পূর্ণতা পায়, একজন মা হয়।
এই সময়টাতে যে যন্ত্রণা, ব্যথা একজন মেয়ে সহ্য করে, তা কেবল তারাই জানে।
যদি কোনো পুরুষ একবারের জন্যও এই যন্ত্রণা অনুভব করতে পারতো, তাহলে প্রতিদিন নারীকে সম্মান করত—শুধু একটি দিন নয়।

আমরা বাঙালি হয়েও শিক্ষার আলোতে যেন অন্ধ!
পিরিয়ড নিয়ে কেউ কথা বললেই কটুক্তি, হাসাহাসি, একঘরে করে দেওয়া হয়।
অনেকে বলে, “ওর পিরিয়ড হইছে”—এমন কথা শুনে মেয়েটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
তার ভেতরের যে বড় হয়ে ওঠার ইচ্ছাশক্তি, তা এক নিমেষে হারিয়ে যায়।

আমরা ভুলে যাই—এই পিরিয়ডই আমাদের জন্ম দিয়েছে।

অনেকে প্যাড ব্যবহার করতে পারে না অর্থের অভাবে।
সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্যাড দেওয়ার কথা থাকলেও তা অনেকের কাছেই পৌঁছায় না।
যে দেশে দু’তিন টাকায় প্যাড মেলে, আমাদের দেশে সেটা ৬০ টাকা, ১০০ টাকা, এমনকি ২০০ টাকা পর্যন্ত!
অনেক পরিবারে খাবারের ব্যবস্থাই কষ্টসাধ্য, সেখানে মেয়ের জন্য প্যাড কেনা এক বিশাল বোঝা।
তাই অনেকেই অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করে, যা থেকে হয় সংক্রমণ, এমনকি সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা।

আরেক বিপজ্জনক বিষয় হলো—নকল প্যাড।
লাভের আশায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে খেলা করে।
তারা জানে না, এই ভুলটা একটা মেয়ের সারাজীবনের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সরকার কি পারে না, এই প্যাড বিনামূল্যে প্রতিটি মেয়ের কাছে পৌঁছে দিতে?
একটা মা, একটা বোন, একটা কিশোরীর পাশে দাঁড়াতে?

নারী কখনো ভয় পেয়ে পিছিয়ে থাকেনি—না একাত্তরে, না চব্বিশে।
আমি নিজেও একজন আন্দোলনকারী ছিলাম—রোদ, বৃষ্টি, কাঁদা মেখে ছেলেদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছি।
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—নারীরা কি সত্যিই স্বাধীন?

আজও দেশে নারী নিরাপদ নয়। কোথাও না।
তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো মেরুদণ্ডওয়ালা মানুষ নেই বললেই চলে।
আমরা ছোট বোন ‘আসিয়া’র কথা ভুলে গেছি।
তার বিচার আজও হয়নি। আমাদের সমাজ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে—ধামাচাপা পড়ে যায় সব।

কিশোরী মন অনেক কিছু বোঝে, কিন্তু বলা হয় না।
ভালোবাসার পবিত্রতাও হারিয়ে যায় এই বয়সে।
ভুল সম্পর্ক, প্রতারণা—সবকিছু মিলে এক সময় একা হয়ে যায় মেয়েটি।
কেউ বাঁচে, কেউ হারিয়ে যায় পৃথিবীর মায়া ছেড়ে।

তাই আমি বলব,
প্রত্যেক মা-বাবার উচিত সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা।
তারা যেন মা-বাবার সাথেই নিজের কথা বলতে পারে, কাউকে খুঁজতে না হয়।

একজন মা হয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করি—আমার সন্তানের প্রথম বন্ধু আমি হবো।
তার বাহিরে আর কোনো বন্ধুর প্রয়োজন হবে না।

আমাদের তরুণ প্রজন্মই ভবিষ্যৎ। তারা যদি ভেঙে পড়ে, তাহলে দেশও ধ্বংসের পথে।
প্রত্যেক পুরুষের উচিত নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।
সহযোগিতা না পারলেও, কটু কথা বলে মানসিকভাবে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকুক।

আমরা যদি আজই নিজেদের ভুল শুধরে নেই,
তবে আগামী দিনে কোনো মেয়ের কৈশোর হবে না দুঃখময়—বরং হয়ে উঠবে আনন্দময়, নিরাপদ ও সম্মানজনক। লেখক: শিক্ষার্থী ও সংগঠক 

  1. লেখিকা: ফাইজা রহমান অনু

সারাদেশ বিভাগের আরো খবর

আরও খবর
এক ক্লিকে বিভাগের খবর