গৌরীপুর প্রতিনিধি : স্বামী হারানোর ৪মাস আজ! পাঞ্জাবী, টিশার্ট আর টাওয়ালে স্বামীর ঘ্রাণ খোঁজে ফিরছেন মোছা. মারজিনা আক্তার। এক মুর্হূতের জন্যও স্বামীর মধুময় স্মৃতি ভুলতে পারছেন না তিনি। প্রতিরাত কাটছে স্বামীর পাঞ্জাবী গায়ে জড়িয়ে, কখনও কখনও টি-শার্ট হাতে নিয়ে অঝোরে কাঁদছেন, কখনও টাওয়ালে মুখ গুজে স্মৃতিমন্থর করছেন। এভাবেই দিন কাটছে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ জোবায়ের আহম্মেদের স্ত্রী মোছা. মারজিনা আক্তারের। তিনি ঈশ^রগঞ্জ উপজেলার বড়হিত ইউনিয়নের বৃ-পাচাশী গ্রামের মো. শহীদুল্লাহ’র কন্যা।
বুধবার (২০ নভেম্বর/২০২৪) বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মারজিনা আক্তারের বিছানার এপাশ-ওপাশে স্বামীর পাঞ্জাবী-টিশার্ট আর টাওয়াল ছড়িয়ে আছে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যূত্থানে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে উপজেলার কলতাপাড়ায় ২০জুলাই পুলিশের গুলিতে শহিদ হন জোবায়ের আহম্মেদ। এই দিনে কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে আরও ২জন শহিদ হন। তারা হলেন ডৌহাখলা ইউনিয়নের চুড়ালী গ্রামের বাবুল মিয়ার পুত্র বিপ্লব হাসান (১৯) ও রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও মধ্যপাড়ার আব্দুল হালিম শেখের পুত্র নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব (২২)।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জোবায়ের নিয়মিত অংশ নিতেন। এ আন্দোলনে শরীক হতে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে ছুটে গেছেন ময়মনসিংহে। তবে স্ত্রী নিকট বলতেন খেলতে যাত্রী। ক্রিকেট খেলা ছিলো জোবায়ের প্রিয়। ২০২৩সনের জুন মাসে জোবায়ের-মারজিনার বিয়ে হয়। এ আন্দোলনে অংশ নিতে স্ত্রীকে বলতেন খেলতে যাবেন। তার প্রিয় খাবার ছিলো গরুর মাংস আর ডিম। ২০জুলাই সকালে ছোট মাছের সঙ্গে বেগুন-আলু’র তরকারির সাথে ছিলো ডিম ভুনাও। খাওয়া-দাওয়া সের কলতাপাড়ার আন্দোলনে যেতে জোবায়ের আহম্মেদ নিত্যদিনের মতো সকালেই প্রস্তুতি নেন। এ প্রসঙ্গে মোছা. মারজিনা আক্তার বলেন, বের হওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছে, ঠিক সেই সময় কল আসে। ওইপ্রান্তে যাঁরা ছিলো, তাঁদেরকে বলেছে একটু দাঁড়া বের হচ্ছি। আমাকে বলেছে, দোকানে পরে যাবে, এখন খেলতে যাবে, বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তা করো না, চলে আসবো। এ সময় আমার কাছে ১০০টাকা চায়, ওরই দেয়া ছিলো। বললাম ৫০টাকা খরচ হয়ে গেছে, আর ৫০টাকা নিয়েই সে বেড়িয়ে যায় এ আন্দোলনে। কথাগুলো বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার এক-দু ঘন্টার মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি আসে। দেখি, এ আমার ‘জোবায়ের’। ওর নিথর দেহ দেখে, আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। হাত-পা অবশ হয়ে যায়। ৮দিন পরে আমার জ্ঞান ফিরে। জোবায়ের, জোবায়ের বলে ডাকি, ওতো সাড়া দেয় না, কথা বলে না; এরপরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি।
তিনি আরও বলেন, বাবা নিয়ে আসেন। তখনও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। হাতেও কোনো শক্তি ছিলো না। অন্যের সহযোগিতায় কাপড়-চোপড় বদলাতে হতো। আমিও জোবায়েরের সঙ্গে যেতে চাই, সেতো আমাকে নিলো না। একাই চলে গেলো।
মারজিনার বাবা মো. শহীদুল্লাহ জানান, মেয়ের জামাই নেই; মেয়ে অসুস্থ্য। মেয়েকে সুস্থ করার জন্য একেকবার একেক ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছি। সেতো মানসিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলো। আমার ২ ছেলে আর ৩ মেয়ের মধ্যে সে ৪র্থ। তাকে ভালো করার জন্য পরিবারের সবাই অস্থির হয়ে পড়ে। প্রায় ৪০হাজার টাকা তখন ব্যয় হয়। মাতা মোছা. মনোয়ারা খাতুন বলেন, টেলিভিশনে বা পত্রিকায় গণঅভ্যুত্থানের ছবি বা খবর দেখলেই সে হাউমাউ করে কান্না করে। জোবায়েরকে খোঁজে, তখন ওর বিয়ের পাঞ্জাবী, টিশার্ট আর টাওয়ালের গন্ধ শুকে। এমন দৃশ্য দেখলে পৃথিবীর কোনো মা স্থির থাকতে পারে না, আমিও মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছি। ওকে কি; বলে শান্তনা দিবো। ছেলে-মেয়ের বয়স সংক্রান্ত জটিলতা থাকায় ধর্মীয়-সামাজিকভাবে ২০২৩সনের জুনে বিয়ে হলেও বিয়ের রেজিষ্ট্রি হয় এ বছরের ১৩এপ্রিল।
শহিদ জোবায়ের আহম্মেদের লাশ আন্দোলনকারীরা বাড়িতে ওইদিনেই পৌঁছে দেয়। ছেলের জানাযায় ইমামতি করেন তার বাবা মো. আনোয়ার উদ্দিন। জোবায়ের কাউরাট আকবর আলী দাখিল মাদরাসা থেকে ৮ম শ্রেণি পাশ করেন। এরপরে গৌরীপুর টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। দিয়ে ছিলেন এসএসসি পরীক্ষা। এক বিষয়ে ক্রস থাকায় আবারও পরীক্ষা দেন। এ কারিগরী কলেজ পড়া অবস্থাতেই পুরাতন মোবাইল কেনার ব্যবসা শুরু করেন। শম্ভুগঞ্জ এলাকায় দোকান ভাড়া নিয়ে তিনি পুরাতন মোবাইল কিনে তার যন্ত্রাংশ বিক্রি করতেন। একপর্যায়ে ব্যবসার পরিধি ব্যাপকতা হলে তিনি নিজে ভারত থেকে চীন থেকে মোবাইলের যন্ত্রাংশ আমদানি এবং নতুন মোবাইল ফোন আমদানি করতেন। এছাড়াও পুরাতন মোবাইলের যন্ত্রাংশও রপ্তানি করতেন তিনি। তার আয়ে পুরো সংসারটি ঘুরে দাঁড়ায়।
তিনি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মইলাকান্দা ইউনিয়নের পূর্বকাউরাট গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোহাম্মদ আনোয়ার উদ্দিনের পুত্র। ৬ কন্যা আর ৩ পুত্র সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ৮ম। জোবায়েরের বড় বোন উম্মে হানিফ শ্যামগঞ্জ ফাজিল মাদরাসার কামিল পরীক্ষার্থী। সবার ছোট ভাই মো. কাউসার আহাম্মদ একই মাদরাসা থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী।
আপনার মতামত লিখুন :